Importance of sohojpath | sohoj pather goppo

 শিশু সাহিত্যে সহজপাঠের অবদান

© স্মৃতিকনা গোলদার


"সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে

সহজ কথা যায় না লেখা সহজে"


যিনি একথা বলেছেন -- সেই বিশ্বকবিই আমাদের শুনিয়েছেন অতি সহজ কথা, তাঁর চিরন্তন সৃষ্টি সহজপাঠ প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগের মধ্য দিয়ে।

illustration: pngtree.com

'সহজপাঠ' দুটি ভাগের গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি মূলত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লেখা 'বর্ণপরিচয়" পুস্তকটির দুটি ভাগের পরবর্তী ধাপ হিসেবে। কারণ একটি শিশু যখন স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়, তখন সে শুধুমাত্র বর্ণ চিনেই ক্ষান্ত হয় না। আরও নতুন কিছু পড়তে চায়। সহজপাঠ সেই নতুন ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে শিশুদের সামনে। যদিও এই পুস্তকে রবীন্দ্রনাথ স্বরবর্ণ অর্থাৎ অ-আ থেকেই শুরু করেছেন শিশুর হাঁটি-হাঁটি পায়ে পথ চলা। ছোটো খোকা কথা-কওয়া শেখেনি, কিন্তু অ-আ বলার তার অদম্য ইচ্ছা। এই ইচ্ছাই শিশুদের নিয়ে যায় সেই অজানার জগতে -- অচেনার আনন্দকে খুঁজে নিতে।

এবার আসি সাহিত্যক্ষেত্রে সহজপাঠের অবদান বিষয়ে। আসলে এমন একটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া আমার পক্ষে দুঃসাহসের কাজ তবু লেখার খাতিরে বলতে পারি যে, সহজপাঠ আমাদের প্রকৃতি ও পরিবারকে চিনতে শিখিয়েছে। প্রতিটি পরিবারের শিশু তার মাকে দেখে বুঝেছে মায়ের গুরুত্ব। 'বড়ো বৌ' ভাত আনবে অর্থাৎ একটি একান্নবর্তী পরিবারের সুন্দর ছবি এখানে আমরা পাই যা পরবর্তীকালে আমাদের সাহিত্যকে নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছে। এর সঙ্গে রয়েছে আমাদের এই সুন্দর প্রকৃতির কোলে আনন্দ-পাঠ। সারা বছরের ছয়টি ঋতুর চক্রাকার আবর্তন এই বই দুটিতে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত। ঘরের কোণে আবদ্ধ না থেকে প্রকৃতিকে চেনা এবং তার সঙ্গে থেকে বড়ো হওয়া -- এই ভাবনা থেকেই ভবিষ্যতে জন্ম নিয়েছে শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যপূর্ণ আদর্শ। প্রকৃতির নয়ন-ভুলানো সৌন্দর্য্য তার সঙ্গে চারিপাশের প্রাণীকুলের বিভিন্নরকম প্রতিক্রিয়া -- প্রতিটি ঋতুতে তাদের আচরণের পরিবর্তন -- এ সবই সহজপাঠের পাতায় পাতায় বিবৃত।

এবার আসি শিশু সাহিত্যের প্রসঙ্গে। শিশুদের জন্য রবীন্দ্রনাথ অনেকরকম চিন্তাভাবনা করেছেন, যার প্রতিফলন ঘটেছে শিশু, শিশু ভোলানাথ ইত্যাদি কাব্যে এবং তাঁর বিভিন্ন নাটকে। যেখানে শিশুরা বদ্ধ ঘরের দেওয়াল থেকে মুক্তির জন্য আকুল হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে বা তাঁর সমসাময়িক কবিদের মধ্যে এই সহজপাঠের একটা পরোক্ষ প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি। যেমন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লীলা মজুমদার, এছাড়াও আরও অনেক কবি ও সাহিত্যিকের লেখায় আমরা সহজপাঠকেই যেন অন্যরূপে পাই। ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা -- এইসব গ্রন্থে যে রূপকথা বা কল্পনার জগৎ -- যেখানে শিশুমন পায় মুক্তির স্বাদ, স্বপ্নের সঙ্গে পারে খেলা করতে -- এ তো সহজপাঠেরই এক পরিবর্তিত রূপ। আবার টুনটুনি আর রাজার গল্প, রূপকথার রাজ্যে শিশুমনের অবাধ বিচরণ, আবোলতাবোলের মজার ছড়া -- এ সবই শিশুমনের ঘুম ভাঙিয়ে তাকে প্রকৃতির অঙ্গনে এনে হাজির করেছে। সহজপাঠের ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমির কথা, রাজপুত্তুর আর রাজকন্যার কথা, রাক্ষস-খোক্কসের গল্প নতুন করে ধরা দিয়েছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের "ঠাকুরমার ঝুলি", "ঠাকুরদাদার ঝুলি"তে। গাছপালার সঙ্গে প্রাণীজগতের এই যে একটা সুরসমৃদ্ধ মেলবন্ধন -- এ যে সহজপাঠেরই রূপান্তরিত চিত্ররূপ। যেখানে ছোটোখোকার অক্ষর পরিচয় থেকে শুরু করে তার স্বাধীন চিন্তাভাবনা -- সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। শিশুদের যে কোথাও হারিয়ে যেতে মানা নেই সেকথা বারবার আমাদের শিশুসাহিত্যের কারিগররা মনে করিয়ে দিয়েছেন। শিশুমন প্রশ্ন রেখেছে -- সে যা চায় তা কি কখনোই বাস্তবে রূপ পাবে না? আমাদের বাংলা সাহিত্যের যাঁরা বিখ্যাত লেখক লেখিকা তাঁরা কোনো না কোনো সময়ে নিজেদের শৈশব ফিরে পেতে চেয়েছেন এই সহজপাঠের হাত ধরেই। সেখানে শুধু শিশুসাহিত্য নয়, সার্বিকভাবেই সর্বত্র বিরাজ করছে সহজপাঠের আনন্দধারা। আমরা যারা জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে এসেছি এখনো শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের সময় সহজপাঠের বিভিন্ন কবিতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরি। তখন বারবার মনে হয় এ যেন আমাদের মজ্জায় মিশে আছে। যে বই দুটো আমরা প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে এসেছি সেই বই দুটোর পাতায় পাতায় রয়েছে আমাদের শৈশব। "সাতসাগরের পারিজাত বনে" আমরা "কখন যেন অন্যমনে" পৌঁছে যাই নিজেরাই বুঝতে পারি না। আসলে একালের কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যেও যে শিশুসুলভ আনন্দ দেওয়ার একটি ভাবনা রয়েছে তার উৎস কিন্ত সহজপাঠ। নির্মল হাসির জন্য, মনের খোরাকের জন্য, রূপকথার জগতে অবাধে বিচরণ করার জন্য যদি কোনো পুস্তকের কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার করতে হয় সেটি অবশ্যই সহজপাঠ। দুটি অংশে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রকৃতি চেতনা, নীতিবোধ, সাহসিকতা -- সমস্তকিছুই ছড়িয়ে আছে। তা না হলে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'কলের কলকাতা' গল্প পড়তে গিয়ে কেন মনে পড়ে "কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে"?

আলোচনা শেষপ্রান্তে এসে মনে হচ্ছে, অনেক শিশুসাহিত্যের কথা সাহিত্যিকের কথা হয়তো উল্লেখ করা হলো না। এই অনিবার্য ত্রুটি পাঠককুল নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন আশা রাখি। আসলে আমাদের বাংলা সাহিত্যের লেখক লেখিকারা 'সহজপাঠ' নামক শিকড়টিকে কখনোই এড়িয়ে চলতে পারেননি। কারণ এটি তো আমাদের কাছে বিরাট মহীরুহের মতো। এর ছত্রছায়াতেই তো বাংলার শিশুসাহিত্য শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে। তাই সবশেষে আমি এই আশা করবো যে, বাংলা-বিস্মৃত বাঙালীর ঘরে ঘরে সহজপাঠ বিরাজ করুক এবং আমাদের শিশুদের মুখে মুখে এর ছন্দোময় বাণীর ঝংকার।

"কতদিন ভাবে ফুল উড়ে যাবে কবে,

যেথা খুশি সেথা যাব ভারী মজা হবে।"

Comments