Nogno Onuvuti | Bengali Love story | Naked Feelings |

নগ্ন অনুভূতি
- আহসান  শ্রাবণ

Nogno onuvuti
||১||

একটা পরিপূর্ণ বিকাল আর কিভাবে আসতে পারে? দুপুরের খররৌদ্রকে সে দিনের মতো প্রতিস্থাপিত করে নিয়েছে এক পশলা বৃষ্টি।একটা ঘন্টা যাবৎ বৃষ্টি হওয়াতে নগরের বুকে গরম বিদায় হয়ে একটু শীতল প্রশান্তিই এসেছে-বলা যায়। অবশ্য তা দেখাও যাচ্ছে বেশ।গাছের পাতা, থোকায় থোকায় ফুটন্ত ফুল সবকিছুর সম্পৃক্তি (saturation) বেড়ে গেছে যেন।প্রকৃতির সব রঙগুলোকে আরও বেশি উজ্জল মনে হচ্ছে।যেন প্রাণে নতুন উদ্যমের সঞ্চার হয়েছে। আকাশটাও পরিষ্কার বেশ।খুব করে আসমানি নীল বর্ণ ধারণ করে আছে। তেমন একটা মেঘের পায়চারিও নেই।নগরজীবন ও যেন ১ টা ঘণ্টার বিরতির পর আবারো খোশ মেজাজে চল শুরু করেছে।

পার্কের কাঠের বেঞ্চটায় বসে এতসব দেখে নিতে ভালোই লাগছে সিয়ামের। মেজাজটাও ফুরফুরে বেশ। বৃষ্টি হওয়াতে আরও ভালো লাগছে। পার্ক সিয়ামের বাসা থেকে বেশ খানিকটা পেছনে। যখন বের হয় তখন বাসার ওখানটায় বৃষ্টি শুরু হয়। ততক্ষণে পার্কে বৃষ্টি শেষ। তাই সিয়াম তাড়াতাড়ি একটা রিক্সা ঠিক করে পার্কে এসে বসে। সেঁজুতি এখনো আসেনি। আজ বেশ ক বছর পর আনুষ্ঠানিকতায় দেখা করছে তারা। এর আগে এমন হয়েছে সম্ভবত অর্ধযুগ আগে। ফেসবুকে কয়েক দিন আগেই হুট করে কথা হয় তাদের। কথা গাঢ় হয় দিনে-দিনে। এরপর কি মনে করে দুজনেই দেখা করতে সম্মত হয়। আবারো। সিয়াম জানেনা কি হবে না হবে। সকালে একবার নিজের মনের সাথে খানিকক্ষণ যুক্তি পরামর্শ করেছে। দেখা করা ঠিক হবে কি না, কি জন্যে দেখা করতে হবে, ফোনে- ফোনে যতটুকু কথাবার্তা চলছিল তা-ই কি যথেষ্ট না? এসব নিয়ে সিয়ামের মন আর মস্তিষ্কের বেশ ভালো একটা দ্বন্দ্বই হয়েছে। আসলে মনই বায়না করেছে যাওয়ার ওদিকে মস্তিষ্ক প্রশ্ন তুলছে কারণ সে ঠিক করতে পারেনি গিয়ে কি বলবে? কি কি বলবে, শুনতে চাইবে, যাওয়ার উপলক্ষই বা কি ইত্যাদি। ওয়াশরুমে মলত্যাগ করতে বসে এহেন দ্বন্দ্ব-বিতর্ক নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাপার সিয়ামের জন্য। শেষতক যুক্তি খন্ডন করে সিয়াম নিজেই। এই ভেবে যে, মানুষকে সবসময় ছাঁচে ফেলে বিচার করা যায়না। প্রাণিজগতের অন্যান্য প্রাণির মতো সেও অনিশ্চিত। তার বুদ্ধিবৃত্তি তার সম্পদ, যার শক্তিতে নব্য যে কোন পরিস্থিতিকে কোন না কোনভাবে মোকাবিলার ক্ষমতা সে রাখে। আর তা-ই একসময়ের অনিশ্চিত পৃথিবীর বুকে আজ মানুষের নিশ্চিত আধিপত্য। যা-ই হোক আজ, সিয়াম প্রস্তুত। এই ভেবে পরিষ্কার করে সিয়াম ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছিল।

সেঁজুতি কল দিয়েছে। রিসিভ করলো। সে দাঁড়িয়ে আছে গেইটে, কোথায় আসবে জানতে চায়। সিয়াম ওখানে থাকতে বলল, সে যাচ্ছে। কিন্তু সেঁজুতি দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটা ধরে। পার্কের ভিতরের দিকে। বেশি না ত্রিশ গজ হেঁটেই দেখতে পেল সিয়ামকে। পার্কটি নতুন করে সাজানো হয়েছে একবছর হলো। গাছপালার খুব বেশি পরিমার্জন করা হয়নি। পরিবর্তন হয়েছে বিন্যাসে। মাঝখানে লেকটি ইংরেজি ‘U’ (ইউ) আকৃতির। পুরো লেক ঘিরে থাকা পাড় ও ঐ আকৃতির। লেককে ঘিরেই পার্কের ল্যান্ডস্কেপ। সিয়াম সেঁজুতিকে নিয়ে এসে লেকের পাড়ে পার্কের একটা বেঞ্চে বসে। বেঞ্চের দুপাশে দুটি অর্জুন গাছ, ডালপালা জড়াজড়ি করে আছে। আর সামনে একটি পাকুর গাছ লেকের ঠিক পাড়েই। বর্ষায় লেকের পানি বাড়লে মনে হয় পাকুর গাছটিকেও ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু এখন গ্রীষ্মকাল। এই সময়ে পরিপূর্ণ বিকাল ধারনা করাও যায়না। অন্তত বাংলাদেশে না। তবে আজকের বিকালটা আসলেই পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে সিয়ামের। সেঁজুতি কি ভাবছে জানা যাচ্ছেনা। কথা শুরু করলে বোঝা যাবে। সিয়ামের মস্তিষ্ক কথা শুরু করবার জন্যই বোধ করি বারেবারে দেখে নিচ্ছে সেঁজুতিকে। গাঢ় সবুজ জমিনে সাদার বুটিক, এমন একটি থ্রিপিছ পড়েছে সে। বেশ সাধারণ, কিন্তু এরই মধ্যে তাকে অসাধারণ করে তুলেছে তার গালের লাল আভা। আর চোখে এক টুকরো হাসির রেখা। এই রেখার সাথে অনেক দিনের পরিচয় সিয়ামের। সে এরই তো প্রেমে পড়ে একটি চাতকের জীবন কাটাতে চেয়েছিল। না,আজ এতদিন পরে সেসব কথা আর তুলবেনা।

||২||

সেঁজুতিই প্রথম বলে উঠল, কতক্ষণ হলো বসে আছো ?

- এইতো বেশিনা। দশ মিনিট হবে। বৃষ্টি পেয়েছিলে নাকি আসার পথে?

- নাহ, তুমি যখন বললে বের হয়েছ তখন বৃষ্টি শেষ হয়েছে। এরপরে বের হয়েছি।

- আমরা কোন রেস্টুরেন্টে বসলাম না কেন?

- রেস্টুরেন্টে বসলে কি কথা বলার সময় চোখের সামনে আকাশের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতে ?

- নাহ। পাকুর গাছে থাকা পাখিদের বিকেলের ঝগড়া অবশ্য শোনা লাগতো না। তবে মানুষের অনর্থক ঝগড়ার চেয়ে ভালো।

- ঠিক বলেছ। তোমার ক্ষিদে পেলে বলো, রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাবে।

- নাহ,খেয়েই এসেছি।

- আমিও। তাহলে আবার রেস্টুরেন্টের কথ বলো কেন ? খেয়াল করেছ, বিকেলটা সুন্দর।

- হ্যা, তুমি আসার আগে তা-ই দেখছিলাম আমি।

- আচ্ছা এই পার্কটা নতুন সাজিয়েছে মনে হচ্ছে।

- হ্যা, আগের থেকে পরিবর্তন বলতে মাঝের এই লেকটার আকৃতি দেয়া হয়েছে। পাড় কেটে সমান করে দেয়া হয়েছে। আগের মতো এবড়ো-থেবড়ো পাড় আর নেই এখন।

- উন্নয়ন হয়েছে এই ক’বছরে।

- এক বছর হলো। নতুন করার পরে আজই প্রথম এলাম।  আর্মিরা কাজ করেছে। এখন তো আর্মিরা প্রায়ই অনেক প্রজেক্ট ই পাচ্ছে। তাদের কন্সট্রাকশন পার্টটা তারা বেশ সিনসিয়ারিটির সাথে করে। সম্পূর্ণ ডিসিপ্লিনড। আমরা স্কুল-কলেজের সময়ে এখানে যেমনটা দেখতাম এখন কিছুই নেই।  নকশা বদলের ফলে পরিবেশটাই বদলে গেছে।

- হ্যা, অনেক কিছুরই বদল হয়েছে। ভাঙ্গাচোরা পাড়গুলো সমান হয়েছে।

খানিক নীরবতার পরে সেঁজুতিই আবার হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে 

- তারপর, আমার প্রতি ঘৃণার অবসান হইছে তোমার ?

- হ্যা,অনেকটা।

- অনেকটা মানে? জমিয়ে রেখেছ নাকি কিছু?

- দধি পাতার জন্য আগের কিছুটা দধি রেখে দিতে হয়। আমিও রেখে দিছি। যদি আবার ঘৃণা করার সময় আসে, তখন যদি না করতে পারি? তাই কিছু জমিয়ে রেখেছি, ঐ সময়ে আবার ঘৃণা পাতা যাবে।

কিছুটা হেসে নিয়ে সেঁজুতি বলেই ফেললো, সেসময় এবার আসতে দিচ্ছিনা, সিয়াম। যেটুকু জমা আছে সেটুকুও প্রশমিত হয়ে যাবে। বলেই লেকের জল থেকে চোখ সরিয়ে সিয়ামের দিকে তাকায় সে।

সিয়াম চুপ করে আছে।

সেঁজুতি আবার প্রশ্ন করে, কি হয়েছে,বলছ না যে কিছু।

সিয়াম বলে ওঠে , এতকিছু তো আশা করিনি। তাও যদি এসব হয়, খাপ খাওয়াতে পারব কিনা তা-ই ভাবছি।  

- মেনে নিতে হয়ত প্রথমে অস্বস্তি কাজ করে। অপ্রস্তুতির কারণে। প্রস্তুত থাকলে সহজ ই হয়ে যেত, কথাটা বলতে বলতে কেমন যেন উদাস হয়ে আসে সেঁজুতির স্বর। কে জানে কি মনে করে!

- আচ্ছা সেঁজুতি এই ক’টা বছর কি মনে ভ্যাকেন্সিই রেখে গেছ?

- নাহ। লেনদেন তো হয়েছেই হিসাবে-বেহিসাবে। সেসব ক্লোজড একাউন্ট এখন। তুমি তো বেশ জমিয়ে প্রেম করেছ।

- জমাতে আর পারলাম কই বলো! সে এখন অন্য কারো সাথে জমাট বেঁধেছে। শেষ ২ বছর ভ্যাকেন্সিতে অভ্যস্ত থাকা হয়েছে। এখন মনে হয় উপভোগ করতে শিখে গেছি।

- তোমরা কন্টিনিউ করলে না কেন? আমিতো শুনেছি বহ্নি আর তুমি বেশ সুখেই ছিলে।

- সুখে ছিলাম। তবে মনে হয় সুখ সইত না আজীবন। আমি ওকে পেলে সুখী হয়ে নিতাম আমার মত, কিন্তু ও আবার ভিন্ন কায়দায় হিসাব করে। অপেক্ষা করতে পারত না আমার জন্য। তাই অন্যভাবে সুখ খুঁজে নিয়েছে।

- তুমি চেষ্টা করনি ? যাতে স্টে (stay) করে।

- করেছি। কিন্তু সিলেবাস বহির্ভূত কিছু করতে পারিনি। অনার্সের পর উচ্চশিক্ষার চিন্তা থাকলেও তা বাদ দিয়ে চাকরি খুঁজেছি। পাইনি, আরও খুঁজেছি। পরে যখন মনমতো কিছু মিলছিল না, ভেবেছি যা পাই তা-ই করবো। কিন্তু তখন আর ন্যূনতম কিছুও জোটেনি। ওকেও শান্ত রাখতে হতো তখন। যদিও বেশি মাস করা লাগেনি। আমাদের গ্র্যাজুয়েশন এর ৮ মাসের মাথায় ওর বিয়ে হয়ে যায়। তার ২ মাস পরে আমিও একটা চাকরি জোগাড় করে ফেলি।

- বাচ্চাকাচ্চা হয়েছে কিছু বহ্নির ?

- খোঁজ রাখিনি। চাকরি পাওয়ার পরে ভেবেছি করবোনা, যার জন্য চাকরি করাটা প্রয়োজন ছিল তার কাছেই এখন আমি অপ্রয়োজনীয়। পরে ভাবলাম দেশের বাহিরে যাবো, নিজের সঞ্চয়টুকু বাড়িয়ে নিই। কিন্তু তুমি আমার খোঁজ রেখেছ- এটা অপ্রত্যাশিত ছিল।

- খোঁজ রেখেছি বলতে, খোঁজ পেতাম আর কি। অপ্রত্যাশিতভাবেই চলে আসত। কিভাবে আসত তুমি শুনলে তুমিও হাসবে।

- হ্যা,জীবন এমনই বোধ হয়। যা চাই, তা পাইনা; যা পাই, তা চাইনা।

- না সিয়াম, চাওয়া-পাওয়া ই সব না জীবনের। আমাদের জীবনে অনেক কিছুই আছে যা আমরা আশা করিনা। কল্পনায়ও আনিনা। কিন্তু তাসত্ত্বেও সেসব এসে যায় । আজকের এই সুন্দর বিকাল কে চেয়েছিল বলো? কিন্তু ও যে এসে গেছে ওর নিয়মে, কেউ কি অগ্রাহ্য করতে পারবে? পারবেনা। প্রকৃতির নিয়মের কাছে আমাদের রূটিন-লাইফ নিতান্ত তুচ্ছ।

- কথাগুলো মিলে যাচ্ছে, সেঁজুতি। ছয় বছর আগে আমাদের দ্বিমেরুগামিতা আমাদের চিন্তায়ও ছিলনা, যেমন অচিন্ত্য ছিল গত ১ মাস ধরে আবার আমাদের কথাবার্তা কিংবা এই দেখা। চিন্তায় ছিলনা তাও সেসব ঘটনা ঘটেছে। আমরা তখনো অগ্রাহ্য করতে পারিনি, না এখন।

- তবে কি জানো সিয়াম, বৃষ্টি না হলে কিন্তু রংধনু ওঠে না।

- হ্যা, তা ঠিক। বিচ্ছেদ না হলে প্রত্যাবর্তন ও হয়না।

- আরে কি বলো? আমি তো বলেছি রংধ্নুর কথা। ঐ দেখো।

সিয়াম দেখে আকাশে রংধনু হয়েছে। কিন্তু অর্ধবৃত্তটা পুরোপুরি দেখা যাচ্ছেনা?

সেঁজুতি বলে ওঠে, দেখো দুইটা রংধনু। গাঢ়টা আমার, আর এর উপরের হালকাটা তোমার। বলে হেসে দেয়।

সিয়াম চোখ সরিয়ে সেঁজুতির দিকে তাকায়। সে দেখতে পায়, ঐমুখে ছেলেমানুষির একটা হাসি পূর্ণতা পাচ্ছে। রংধনু বৃত্তাকার না অর্ধবৃত্তাকার, পূর্ণ না অপূর্ণ সে জানেনা, জানার ইচ্ছাও নেই এখন। তার শুধু এখন সেঁজুতির মুখে ছেলেমানুষির পূর্ণতা পাওয়া ঐ হাসিটাই দেখতে বেশি ভালো লাগছে।

||৩||

- সিয়াম।

- হ্যা, বলো।

- কি যেন বলছিলে, চিন্তা- অচিন্তার কথা। থামালে কেন, বলোনা।

- ফেলে আসা দিন, আবছা আবছা যেসব মনে আছে, থাকনা ওসব।

- হ্যা, পড়ে থাকুক সেসব। ওগুলা ঘেটে কোনই লাভ নেই। পুড়ে গিয়ে ছাইয়ের এমন আস্তরণ পড়েছে যে একেবারে অনুর্বর হয়ে গেছে। আমি ভাবছিলাম, হয়ত তোমার গল্পে আমি ঘৃণ্য, আস্তাকুড়ের কেউ একজন হিসেবে আছি। কিন্তু আমার ভুল ভাঙলো। তুমি আসলেই ভালো একজন মানুষ। তোমার মতো মানুষকে তার কর্মের ভিত্তিতেই সবসময় বিচার না করে তার সত্তার ভিত্তিতে সম্মান করতে কাউকে দেখিনি। এই জীবনে।

- সেঁজুতি, তুমি আমার প্রথম প্রেম ছিলে। হ্যা হয়ত আমাদের প্রেমটা গড়পড়তা হয়ে ওঠার আগেই পারিপার্শ্বিকতায় সব ভেঙ্গে গিয়েছে। কিন্তু একজন আরেকজনকে অসম্মান করলে কি প্রেম ফিরে পাওয়া যাবে ? আমার কাছে লাগে, তোমাকে দোষারোপ করা , চুলচেরা সমালোচনা এসব নেহায়েত কাদা ছোঁড়াছুড়ি। এগুলো সত্যিকার অর্থে মনকে শান্ত করতে পারেনা। এসব করে সাময়িক যে “জ্বালা জুড়ানো” ভাব আসে বলে মানুষ মনে করে, তা কি জানো? কারাগারে থাকা আসামির চোখে আকাশে মুক্ত পাখিকে দেখা। ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু, আমি নদীর পাড়ে, বাতাসে বসে, মুক্ত আনন্দে আকাশে উড়ন্ত পাখি দেখা মানুষ। আমিও জানি, উড়তে উড়তে সেও ক্লান্ত হয় একসময়। নীড়ে ফিরতে হয় তাকেও। সুতরাং সে উড়ছে, আমি বসে আছি- এই ভেবে আক্ষেপ করলে শুধু মনের এনট্রপি ই বাড়বে। ফলপ্রসূ কিছুই হবেনা।

- আমার বিয়ে হয়ে যাবে, সিয়াম।

- অভিনন্দন তোমায়।


স্মিত হেসে মাথা নাড়ল সেঁজুতি।

-এই যাহ্‌! পাত্র পছন্দ হয়েছে নাকি, তোমার মনের মতে বিয়েটা হচ্ছে নাকি তা না জেনেই অভিনন্দন দিলাম।

- আমিও তো এসব ছাড়াই মাথা নাড়লাম। আমার অমতে কিছুই হচ্ছে না। বিয়ে তো করতেই হবে বলো। গোমড়ামুখো হয়ে না করলেই বরং ভালো। আর মা-বাবার চেনাজানা আছে বেশ ভালোই। বাকিটা ঈশ্বরের ইচ্ছা।

- সেঁজুতি, এনট্রপি বাড়ছে মনে হয়- বলেই সিয়াম হেসে দিলো। সাথে সেঁজুতিও।

- সিয়াম, অনেক কথা জমে ছিল। আজকে সত্যিই হালকা লাগছে নিজেকে। ধন্যবাদ সুন্দর বিকালটাকে আরো সুন্দর করবার জন্য। এখন সত্যই সেসময় তোমার সাথে জমাট না বাঁধার আফসোস হচ্ছে।

সিয়াম বুঝতে পারে, ছয় বছর আগে, অসম্পূর্ণ কৈশোরের যে অধরা প্রেম ছিল, আজ পূর্ণাঙ্গ যৌবনের শেষ কিছু বিকেলে তা মাটি ভেদ করে উঁকি দিতে চাচ্ছে পৃথিবীর নতুন আলোয়। প্রত্যাখানের পরও সেঁজুতি খোঁজ পাওয়া বন্ধ করেনি সিয়ামের। বন্ধ করতেও চায়নি। একটা কিশোর সিয়ামের প্রেমময় উদ্দীপনা যা কিশোরী সেঁজুতির মনে সাড়া জাগাত একটা সময়, সেই উদ্দীপনার কিছু টুকরা সেঁজুতি পুষে রেখেছিল নিজের মাঝে এতটাকাল। তার কারণেই এই উঁকিঝুঁকি। সিয়াম জানে, এভাবে চলতে থাকলে, বিয়ে হয়ে গেলেও সে পূর্ণাঙ্গ হতে পারবেনা। আবার তার কাছে ফিরতেও পারবেনা। এই দ্বন্দ্বের সূর্য আজ বিকেলই চিরতরে অস্ত যাক।

সিয়াম বলে উঠে, “সেঁজুতি,তোমার মাঝে যদি আমার কোন ভগ্নাংশ রয়ে যায়, তবে আজই তা আমাকে দিয়ে যেও।”

- মানে ?

- মানে হলো এই যে আমাদের অখণ্ড অতীত, যে অতীতে কিশোরী তোমার সামনে আমার দুরন্তপনা। হয়ত ভালোলাগা হয়ত নিছক ঐ বয়সের মোহ। এই দোটানার মধ্যকার “মোহ”র কারণেই বুঝি উপেক্ষা করে যেতে পেরেছিলে আমার প্রস্তাব । তবে আজ এতো বছর পরে বিন্দুমাত্র “ভালোলাগাও” তোমার জানায় এ জগতে না হলেও অন্য কোথাও কোন এক জগতে যদি থেকে থাকে তবে এই লেকের জলে ডুবিয়ে যেও।

- কথা খারাপ বলোনি, সিয়াম। সেই চেষ্টাই থাকবে। তবে আমারও তো অভিমান থাকতে পারে! তুমি যেগুলো কখনোই বুঝনি।

-  হ্যা পারে। আবার এও হতে পারে, তুমি বুঝতে দাওনি। বা আমার মনে হতে পারে, আমি বুঝে যাই, তা তুমি চাওনি। সম্ভাব্যতা অনেক কিছুর। কিন্তু প্রাধান্য পাবে সময় কি চায়! সময় চায় তুমি কিছুদিনের মধ্যে সংসারী হবে। পুরোদস্তুর। আমাকে বা আর যতো পুরনো খাতার পাতায় কাটাছেড়া সেসব নামগুলোকে স্মৃতি দাফন করে ফেলবে- এটাই সময়ের দাবী। 

সেঁজুতির বলার নেই কিছুই। সে শুনছে কথাগুলো। আর লেকের জলে থাকা চোখ দেখতে পেল, পাকুর গাছের একটি পাতা ঝরে জলে পড়লো।
 
||৪||

সন্ধ্যা হবে হবে ভাব। গোধূলিবর্ণ আকাশজুড়ে। আজকের গোধূলি এসেছে নীলের ক্যানভাসের একপাশ লাল-হলুদ-কমলা রঙের ঝাঁজ নিয়ে। এর উপর একপাশে, দিগন্ত ছুঁইছুঁই সে পাশে ঈষৎ ছাই বর্ণ ধারণ করে আছে। পাকুর গাছে পাখিদের কিচিরমিচির বেড়ে গেছে। জাগতিক কর্মযজ্ঞের আজকের দিনের মত বিদায়ের সময় ঘনাচ্ছে।

সিয়াম তারই রেশ ধরে বলল, সুন্দর বিকেল। সুন্দর কথোপকথন।

এছাড়া এই মুহূর্তে আর কি বলা যেতে পারে তা ভাবতে পারছে না সিয়াম।  সে জানে এই অনুভূতি কেমন। আর হয়ত দেখা হবেনা এক সময়ের মন জুড়ে থাকা এই মানুষটির সাথে। এই যে আজকে হলো এরও বুঝি দরকার ছিলনা।

এ কোন নিয়ম জানা নেই তবে এমনটা সেঁজুতিও ভাবছে। অনর্থক ছিল হয়ত আজকের দেখা। বছরের পর বছর জুড়ে অনাবৃষ্টিতে থাকা কোন অঞ্চলের মানুষ একটা সময়ে ভুলে যায় “বৃষ্টির আশা” করা। সেই জীবনে হঠাৎ একদিন হয়ত অজান্তে এক পশলা বৃষ্টি এসে আবার অনাবৃষ্টির যুগ এলে যেমনটা লাগে, এ অনুভূতি তেমনই। ঐটুকু বৃষ্টিতে শিকড় অব্দি জল গড়ায়না, জলাশয় ভরেনা, তবু বৃষ্টির ছোঁয়া কি তা আবারো অনুভব করতে পারা যায়। এইটুকুই। তবু অনর্থক তো কত কিছুই হয়। তাকে অর্থবহ করে নেয়াটাই জীবন। 

পার্কের গেটে রিক্সা ঠিক করে সেঁজুতি। বিদায় নেয় সিয়ামের থেকে। শেষবারের মত স্মিত হেসে দুজন দুজনের চোখে চোখ রাখে।

সেই সন্ধ্যায়,
তোমার চোখ ছুঁড়েছিল গড়পড়তা কিছু অভিমান,
আর আমার চোখে এক কৈশোর কথারা ছিল বহমান।

 সেঁজুতির বিদায়ক্ষণের সেই হাসিমুখ দেখে সিয়ামের মন যেন এই লাইন দুটোই বিড়বিড় করে ওঠে। রিক্সা চলতে শুরু করে। সিয়াম আর অপেক্ষা করেনা। সন্ধ্যার গোধূলি রঙ আকাশে রেখে বাড়ির পথ ধরে।

সে একটু খুশি খুশি বোধ করে। এই ভেবে যে সে বুঝি নতুন আলো দেখতে চাওয়া অনুভুতিগুলোকে সমূলে উৎপাটন করতে পেরেছে। পরক্ষণেই হুট করে সেদিন ঝড়ের রাতে পড়া একটি কবিতার অংশ তার মনে পড়ে যায়।

হেনা,

দেবতারা যদি বিষাদের অনুসরণে-

আমার দুয়ারে এসে তোমার ঠিকানা চায়।

আমি কি আমাদের প্রথম দেখার-

সেই মেলার ঠিকানা দেবো?

নাকি প্রথম আলিঙ্গনের সে তটভাঙ্গা শৈবলিনী-

আজ বয়েছে কোথায় তা জানাবো?

নাকি দুপুর-রাত্রির তন্দ্রায় তুমি রোজ যেথায় আসো,

আমার হৃদয়ের সেই পথ বাতলাবো?

সাড়া দিও।

আর যদি আমার আগেই দেবতারা-

ঘুম ভাঙায় তোমার ;

তাদের কাছে সে “টুকরো আমায়” হস্তান্তর করো?

কেননা,

নবজীবন প্রাপ্তির যে ঋণ তোমার মনে পোষা,

সে ঋণ রুদ্ধ করেছে আমার সুস্থ থাকার আশা।

আমায় তুমি মুক্ত করে হয়ে যেও সতী,

দেবতার কাছে চেয়ে নেবো আমি- নতুন অমরাবতী।
 
কবিতাটা মনে করে সে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে ফেরে....

অলঙ্করণ রেডস্টার্টস ডায়েরি (redstarts_diary)

Comments