Chirkut - Bengali Love Story | Short Story

 চিরকুট

লেখায়: জেরিন বিনতে জয়নাল

অলংকরণ: রেডস্টার্টস ডায়েরি (@redstarts_diary)




একটা গল্প শুনবে?

অবাক হলাম কথাটা শুনে,কারণ অচেনা কেউ যে এরূপ প্রশ্ন করতে পারে তা আমার জানা ছিলোনা।

লম্বা ছুটি পেয়েছি,তাই ঢাকা থেকে নিজ শহরে ফেরার জন্য বাসে উঠেছি,গন্তব্য ঠাকুরগাঁও।পাশের সিটে বসা এক বৃদ্ধ দাদু হঠাৎ উপরের প্রশ্নটি করে বসল। 

ভদ্রতা রক্ষায় সামান্য হাসি দিয়ে বললাম,

আমিঃ দাদু আমার মাথাটা বেশ ধরেছে,ঘুমালে ভালো লাগতে পারে।


(অচেনা কারো কাছে কী গল্প শোনা যায়?তাছাড়া এমনেতেও আমি অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা।তাই বিষয়টা এড়িয়ে দিতে চাচ্ছিলাম)


দাদুঃ গল্প শুনলে ভালো লাগবে,খুব সুন্দর গল্প,একটু শোনো ভালো না লাগলে না'হয় আর শোনাব না।


কোনো উপায় না পেয়ে,হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম আর বললাম জ্বি আচ্ছা।


দাদুঃ যুদ্ধের পরের কথা,তখন আমার বয়স ২৩ হবে,প্রায় সবাই ভারত থেকে দেশে ফিরেছে,যারা দেশে ছিলো তারা নতুন করে নিজেদের বাড়ি ঘর গুছিয়ে নিয়েছে।সবাই নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছে।


আমিঃ দাদু কিছু মনে করবেন না প্লিজ,আসলে আমার  যুদ্ধের গল্প ভালো লাগেনা।


দাদুঃ আরে যুদ্ধ না বোকা, আগে শোনো কিছুক্ষণ। 


আমিঃ আচ্ছা।


দাদুঃ বৈশাখের এক বিকাল বেলা বাজার থেকে ফিরছিলাম সাইকেল নিয়ে।গত রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে পথ কর্দমাক্ত ছিলো বলে সাইকেল নিয়ে বহু কষ্টে হেঁটে হেঁটে পারি দিচ্ছিলাম পথ।পথিমধ্যে কিছু রমনীর হাসির শব্দ শুনতে পাই।গ্রামে এমন অহরহ,যে পুকুরপাড়ে কয়েকজন মেয়ে হাসি তামাশা করছে।তাদেরকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে একটি মেয়ের কন্ঠ শুনতে পাই,যাকে বলে কোকিল কন্ঠা।কি সুমধুর কণ্ঠ তার,তার হাসিতে যেন মুক্ত ঝরছিল।সেই মুক্ত ঝরা হাসিকে উপেক্ষা করা আমার পক্ষে সহজ ছিলো না।নিজের অজান্তেই পা দুটো ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ল,জানিনা কতক্ষণ সেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম।


হুস ফিরল গ্রামের চৌকিদারের ডাকে,


চৌকিদারঃ ওই মিয়া,মাইয়া মানুষ দেহো পলায়া পলায়া,লাজ সরমের বালাই নাই নাহি।


তার কথায় তারাহুরো করে চলে যাওয়ার পথে সাইকেল সহ কাদাতে পরে গিয়ে লুটোপুটি খেলাম।


ততক্ষণে সেই মেয়েগুলো পুকুরপাড় থেকে চলে এসেছে,আমাকে কাদা মাখা অবস্থায় দেখে তারা হাসাহাসি করছে সাথে লুকিয়ে মেয়ে দেখা নিয়ে গালাগালও করছে।


মাথা নিচু করে সেখান থেকে সরে পড়লাম।


সন্ধ্যার দিকে আমার আব্বা বাজার থেকে ফিরে এসেই আমার নাম ধরে ডাকা ডাকি শুরু করল,সাথে আম্মাকেও। 


দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আঙিনায় আসলাম,দেখি আম্মাও গোয়াল থেকে বেরিয়েছে ততক্ষণে। 


আম্মা আব্বাকে জিজ্ঞেস করল,


আম্মাঃ কি গো রতনের বাপ,কি অইছে? এইরম চিল্লান কেন?


আব্বাঃ কি আর হওয়ার বাকি রাখছে তোমার বেটায়?পুকুর ঘাটে গিয়া লুকায় লুকায় মেয়েছেলে দেইহা বেরায়,গেরামে কি আর মুখ দেহানের জো রাখছে?


আম্মাঃ ও আল্লাহ,কি কন আপনে? আমার রতন এরম পোলা না।


আব্বাঃ না করলে কি আর চুপ করে খাড়ায় আছে নাহি।


আমিঃ আব্বা চৌকিদার কাকা ভুল বুজছে।আমি ওইহান দিয়া আসতে ছিলাম আর মেয়েগুলা ওইহানে খুব জোরে হাসতে ছিলো,কি হইছে তাই দেখতে ছিলাম ওমনে কাকায় আইসা পড়ছে।


আব্বাঃ জানি জানি,ওই বয়স আমরাও পার করছি।বিয়া কি দিমুনা কইছি একবারও? কয়ডা দিন সবুর কর,দোকানটা বাজারে জমাইতে পারলেই তোমার হাতে তুইলা দিমু আর লক্ষী মাইয়া দেইহা বিয়া পড়ায় দিমু।তাও বাজান মাইয়াগো দিক তাকাইস না,মানুষ খারাপ কয়,আমরা তর বাপ-মা আমরা বুঝি কিন্তু গেরামের মাইনষে তো আর বোজেনা।


আমিঃ আচ্ছা আব্বা,এরপর তেন (থেকে) খেয়াল রাখমুনে।


সেদিন রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম,যদিও সেই হাসির ঝংকার কানে বাজ ছিলো বার বার।


সবটা প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম,দিন কাল বেশ কাটছিল,রোজ কিছুক্ষণের জন্য বাজারে গিয়ে আব্বার দোকানে বসতাম,বন্ধুদের সাথে নদীতে যাইতাম,ঘুরে বেড়াইতাম।


তেমনই একদিন বন্ধুদের সাথে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম হঠাৎ একটা ঢিল এসে মাথায় লাগল,


দাদুঃ ঢিল বোঝো তো,মাটির বড় শক্ত দলা।


আমিঃ জ্বি দাদু বুঝি।


দাদুঃ শূন্য আকাশ থেকে তো ঢিল পড়বে না তাই ঢিল আসল কোথা থেকে সে উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখলাম রাস্তার ধারে লাগানো আমগাছ থেকে কাঁচা আম পাড়ার চেষ্টা করছে কয়েকজন বাচ্চা,তাদের সাথে সেই পুকুর পাড়ের হাসির রাণীও আছে।


তারা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতেই আমার বন্ধু


সাদিক তাকে বলল,


সাদিকঃ রাস্তাঘাটে মানুষ চোখে পড়েনা,যদি বড় কোনো ক্ষতি হইতো,তখন কি করতা?


মেয়েটিঃ ভুল কইরা হইছে,ইচ্ছা কইরা তো আর মানুষ মানুষরে মারে না।


সাদিকঃ বিয়ে দিলে তো বাচ্চার মা হইবা,এই পোলাপানগুলার সাথে ঘোরার বয়স আছে এখন?


মেয়েটিঃ যার বিয়া তার খবর নাই,পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই।


বলেই মুখ মুচরে চলে গেল সেখান থেকে।


আর সাদিক বলল,সালা কিছু কইলি না কেন?তোর হইয়া কইতে গিয়া আমিই ঝারি খাইলাম আর তুই ড্যাবড্যাব করে চাইয়া আছোস।


আমিঃ তরে কিছু কইতে কইছি?


সাদিকঃ ওরে সালা যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর।


আমিঃ চলতো ভাই।


সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারিনি,কি চমৎকার হাসি তার!তার হাসি দিয়েই মানুষের মনে দাগ কেটে দিতে পারবে সে।


বার বার মনে হতো একটিবারের জন্য যদি তার দেখা পেতাম কিন্তু তার ঠিকানা তো দূরের কথা তার নামটাই আমি জানিনা।


মাঝে মাঝে তাকে পুকুর পাড়ে দেখা যেত তবে খুব কম সময় কিন্তু সেখানে তো আর দেখা যায় না,মুগ্ধ হওয়া যায় না।মাঝে মাঝে বাজারে যাওয়ার পথে দেখা যায় হয় খেলছে নয় তো কোনো ফলের গাছে ঝাটাচ্ছে।


কিন্তু কথা বলার সাহস বা সুযোগ কোনোটাই কখনও হয়নি,শুধু দূর থেকে এক পলক দেখেই কেটে গেছে অনেক দিন।


মাস দুয়েক পরে বুঝতে পারলাম আমি যে তার পথ চেয়ে থাকি,আড় চোখে তাকে দেখার চেষ্টা করি,সেটা সে বুঝতে পেরেছে। ভালো খবর হলো সেও আমার দিকে তাকায়,চোখাচোখি হলে লজ্জায় লাল হয়ে যায়,কিছুটা টমেটোর মতো। 


আমার বিষয়টা আমার প্রিয় বন্ধু সাদিক বুঝতে পারে কিন্তু সে সাহায্য করতে পারে না কারণ সে জানার সপ্তাহ খানেক পরেই ঢাকায় চলে আসে,মাঝে মাঝে চিঠিতে কথা হতো সাদিকের সাথে।


তোমার কী খারাপ লাগছে?


আমিঃ না।


দাদুঃ এরপর দীর্ঘ দিন তার কোনো দেখা পাইনি,এরই মধ্যে আমার এক বন্ধুর দাদার বিয়ের দাওয়াতে গেলাম।কনের বাড়ি আমাদের গ্রামের দুই গ্রাম পরে,সেখানে গিয়ে মহারাণীর দেখা পেলাম।


তাকে দেখে খুশি লাগলেও কিছুটা রাগ হলো,এতোদিন কেন সে গায়েব থাকবে?আমার কি তাকে দেখতে ইচ্ছে করে না।


ঠিক করলাম তার সাথে কথা বলবোই কিন্তু বিয়ে বাড়িতে অনেক মানুষ বলে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না।


আমি ঘুরতে লাগলাম তার পিছে পিছে সারা বিয়ে বাড়িতে তবে কিছুটা দূরত্ব রেখে যেন অন্য কেউ সন্দেহ না করে।


কথা বলতে না পারলেও একটা লাভ হলো,তার নাম জানতে পারলাম তার নাম,বর্ষা।


কনের বড় বোন তাকে বলছিলো,"বর্ষা মালা বদলের মালাটা নিয়ে আয়।"


নামটাও তার মতোই সুন্দর। 


হিন্দু নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের রাতে বাসর জাগা হয়,সেখানে বন্ধুর সাথে আমিও থেকে গেলাম,যদি কথা বলতে পারি কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি।


আচ্ছা,তোমার কী বিরক্ত লাগছে?


আমিঃ না না,দাদু আমি ঠিক আছে।


দাদুঃ কোনো প্রশ্ন করছো না যে?


আমিঃ এখনই বলতাম,আপনারা প্রথম কথা বলেছেন কবে?


দাদুঃ ওহ,,প্রথম কথা হয়েছিলো বৌ-ভাতের দিন।



সেদিন তাকে নাম ধরে ডেকেছিলাম,তার নাম ধরে ডাকায় কি যে অবাক হলো,কি বলব।


অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,


বর্ষাঃ আমার নাম জানলেন কিভাবে?


আমিঃ শুনেছি কালকে।


বর্ষাঃ আপনার মশাই চরিত্রে দোষ আছে,কখনও লুকিয়ে মেয়েদের দেখেন,কখনও তাদের পিছু নেন,আবার লুকিয়ে নাম শোনা হচ্ছে।


বলে দেব নাকি বাড়িতে?


আমিঃ দয়া করে বাসায় নালিশ পাঠাবেন না,তাহলে এবার আব্বা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। আমি আর কখনও আপনার পিছু নেবো না। 


বর্ষাঃ এই কলিজা নিয়ে আমার পিছু নেন?আর পিছু নেওয়ার কারণ কী?


আমিঃ কোনো কারণ নাই।


বলেই সেখান থেকে পালালাম,এ মেয়ের ভরসা নেই।


মাস তিনেক পরে বাজারে যাওয়ার পথে তাকে দেখতে পাই,সে একাই ছিলো সেদিন।আমাকে দেখে রাস্তার মাঝে দাঁড়াল তাই বাধ্য হয়ে আমাকেও সাইকেল দাঁড় করাতে হলো,যদিও মনে মনে চাচ্ছিলাম তাকে দেখতে,তার সাথে কথা বলতে। 


আমিঃ বলেন কী বলবেন?


বর্ষাঃ তা আমার নাম তো জানেন,আপনার নামটা কে বলবে শুনি?


আমিঃ রতন।


বর্ষাঃ কথা তো দেখি সাহেবদের মতো বলেন আপনি।


আমিঃ ওই আরকি,কলেজ পর্যন্ত উঠেছিলাম তারপর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল আর পড়া হলোনা।।


বর্ষাঃ বাবারে কলেজেও গেছেন আপনি?


আমিঃ হুম,তা তুমিও তো মনে হয় লেখাপড়া করছো কিছু?


বর্ষাঃ নাহ,মেয়েদের পড়তে নাই,,তবে আমার বাবা আমাকে বাসায় লিখতে আর পড়তে শিখিয়েছে।আমি আমার বাবার বইগুলো পড়ি রোজ।


আমিঃ বই পড়া ভালো। 


বর্ষাঃ হয়েছে যান এখন,কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। 


সেদিন খুব ভালো লাগছিল,চারিদিকটা রঙিন লাগছিল,সব যেন নতুন,সব কিছুতেই ভাল লাগার গন্ধ পাচ্ছিলাম।


মাঠের ধারে রাস্তায় বসে থাকতাম,সে পিছন দিয়ে যাওয়ার সময় আসতে করে চিরকুট ফেলে যেত,সেখানে আমাদের দেখা করার সময় ও জায়গার নাম লেখা থাকত।


কখনও পুরনো ভাঙা দালানে,কখনও স্কুল ঘরের পিছনে,কখনও আবার নদীর তীরেও দেখা করতাম।


এমন অনেক হয়েছে যে,সপ্তাহ খানিক তার পাত্তা নাই।


আমাকে তার বাড়ির ঠিকানা বলতো না,যদি তাকে না পেয়ে তার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করি?তখন কি হবে?


আমিও কখনও তাকে জোর করার সাহস পাইনি,একদিন তার পিছু নিয়েছিলাম কিন্তু ধরা খেয়ে গেলাম।


এভাবেই চলছিল সবকিছু,আমাদের লুকিয়ে দেখা করা,চিরকুটের মাধ্যমে কথা বলা।


তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় আমি সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে যেতাম,কখনও কোনো ফল তো কখনও নিজেদের দোকান থেকে চুরি করে নেয়া কোনো সদাই।সে খেতে খেতে গল্প করত,সেও মাঝে মাঝেই আমার জন্য লুকিয়ে কলাপাতায় পায়েস,পিঠা কিংবা নাড়ু নিয়ে এসেছে।তার হাতে বানানো নাড়কেলের নাড়ু আমার খুব প্রিয়,সে প্রায়ই সেটা নিয়ে আসত আমার জন্য।


বর্ষা খুব ভালো গান করত,কবিতা আবৃত্তিতেও যেন সে সেরা।শিক্ষা জীবনে কবিতা খুব অপছন্দের হলেও সে যখন কবিতা আবৃত্তি করত,আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম,ইচ্ছে করত আজীবন শুনেই যাই।আমাদের মধ্যে অনেক কথা হলেও কখনও তাকে বলতে পারিনি ভালবাসি,কখনও তার হাত ধরা হয়ে ওঠেনি।


যদিও আমি একবার সাহস সঞ্চার করে তার হাত ধরতে গিয়েছিলাম কিন্তু সে রেগে দু'হাত কোমরে দিয়ে বলল,"বড্ড সাহস হয়েছে দেখছি,বিয়ের আগে এসব ভদ্রলোকের কম্ম নয়।" বলেই কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল,তারপর টমেটোর মতো লাজুক মুখটা নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো।


কিন্তু বলে না,সুখ বেশিক্ষণ টেকে না।আমাদেরও টেকেনি।


সেদিনের পর দু'দিন আমাদের দেখা হয়নি,সন্ধ্যায় রান্নাঘরে বসে আম্মার রান্না করা দেখছিলাম আর তার সাথে গল্প করছিলাম হঠাৎ আব্বা হাজির হলো,সোজা গোয়াল ঘরে ঢুকে একটা বাঁশের বেত ভেঙে এনে আচমকাই আমাকে মারতে লাগল।কোনো কারণ ছাড়াই আব্বা আমাকে এভাবে মারছে কেন তা বুঝলাম না,আব্বা আমাকে জীবনে মারেনি,আমাকে সে বড্ড ভালবাসে।আমি যুদ্ধে অংশ নিতে চেয়েছিলাম,আমাদের কলেজের অনেকে নিয়েছিল অংশ কিন্তু আব্বাকে বলার পরেই সে আমার হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘরের মধ্যে আটকে রেখেছিলো যেন যেতে না পারি।তার ভয় ছিলো যদি খোকা না ফেরে যুদ্ধ থেকে?সেই আব্বা আমাকে এভাবে মারছে কেন?


আমি অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছিলাম,তাই তাকে যে মারের কারণ জিজ্ঞেস করব,তাও মনে ছিলোনা।


অন্যদিকে আম্মা,কান্না করছে আর বিলাপ করছে,সাথে আব্বাকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।


আমিও যেন বাধ্য ছেলের মতো মার খেলাম। এক সময় আব্বা নিজেই থেমে গেলেন,বেত ফেলে দিয়ে ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসলেন।তার মুখের কঠিন ভাবটা নিমিষেই মিলিয়ে গেল,ভেসে উঠল এক কোমল বাবার মুখ,দু চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরছিল। জীবনে সেদিনই প্রথম আব্বাকে কান্না করতে দেখেছিলাম,মনে হচ্ছিলো এর থেকে মরে যাওয়া সহজ কাজ।


আম্মাঃ এমনে মারলেন কেন?যদি আমার কইলজাডার কিছু হইয়া যাইত?যদি বে-জাগায় মাইর লাইগা কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যাইত? 


আব্বাঃ ও আমাগো বাঁঁচবার দিবোনা রতনের মা।


গেরামে মুখ দেহান যায় না।গেরামের মানুষ আমাগো বে ঘর কইরা দিবো।


আম্মাঃ কি হরছে আমার রতনে?


আব্বাঃ মুসলমান বাড়ির মাইয়ার লগে ভাব করছে তোমার রতনে।


আম্মাঃ এইডা মিছা কতা,রতন বাজান চুপ মাইরা আছোস কেন?


আব্বাঃ ওর কওনের কিছু নাই।


আমিঃ আব্বা,আমি কোনো মুসলমানের মাইয়ার লগে ভাব করি নাই,আমারে বিশ্বাস কর তুমি।


আব্বাঃ আর মিছা কইস না,ধম্মে সইব না। 


আমিঃ আমি সত্য কইতাছি আব্বা।


আব্বাঃ তুই এক মাইয়ারে নিয়ে নদীর তীরে ঘুইরা বেড়াস নাই? তারে নিয়া স্কুলের পিছনে বইসা গল্প করস নাই? পুরান দালানে যাস নাই? রায় বাবুদের বাগানের পিছনে তারে নিয়ে ঘুরস নাই তুই?


আমিঃ আ....আব...আব্বা ঘুরছি কিন্তু সে তো আমাদের সম্প্রদায়ের,ওর নাম হইলো...


সবাই নামেন নামেন,ত্রিশ মিনিট খাওয়ার জন্য ব্রেক দিলাম।ত্রিশ মিনিট পর গাড়ি ছাড়বে আবার,সবাই সময়ের মধ্যে চলে আসবেন।গাড়িএ নাম্বার দেখে যাবেন,ভুল গাড়িতে উঠলে আমাদের দোষ নাই।  বলেই কন্ডাকটর বাস থেকে নেমে গেলো,সবাই নামতে শুরু করেছে প্রায় ৫ ঘন্টা ধরে বাসে বসে আছে সবাই।


দাদুঃ তোমার কিছু খেয়ে নেয়া উচিত,তোমার না মাথা ব্যাথা? 


আমিঃ হুম কিন্তু বাকিটা জানা হলো না।(গল্পটা শোনার আগ্রহ বেড়ে গেছে কোনো এক কারণে,কিন্তু সেটা বুঝতে দেয়া চলবে না)


দাদুঃ খেতে খেতে না'হয় বাকিটা বলি।


আমিঃ আচ্ছা।


ফ্রেশ হয়ে খাবার অর্ডার করে বসে আছি।


আমিঃ দাদু বাকিটা?


দাদুঃ হুম শোনো,


 আব্বাকে বললাম তার না তো বর্ষা,আর সে মুসলমান হলে কেন হিন্দু বিয়েতে থাকবে।সুজয়ের দাদার বিয়েতে সে ছিল কনে পক্ষ।


আব্বাঃ ওতো কিছু জানিনা বাপু,কিন্তু সেই মেয়েটা মুসলমান,তার বাবা আলেম মানুষ,মসজিদে আযান দেয়।


আমিঃ তুমি এতো নিশ্চিত কিভাবে?


আব্বাঃ তোমার নামে নালিশ দিয়ে গেছে গ্রামের মানুষ,তারাই কইছে সব।আমাদের হিন্দু পাড়ায় থাকতে দিবোনা কইছে।যদি তুমি আর ওই মাইয়ার পিছে যাও তাইলে আমাগো গেরাম ছাড়া করে দিবো।



কোনো কথা না বলেই সেদিন চলে গেছিলাম,নদীর তীরে একা বসে বসে ভাবছিলাম সবটা।


কেন বর্ষা বলেনি সে মুসলমান?আমিও তো বলিনি কখনও। 


আচ্ছা মানুষ কি এটা বলে পরিচিত হয়,সে হিন্দু না মুসলমান?


তার সাথে দেখাও হচ্ছিলো না।নির্ঘুম রাত কাটছিলো,তার হাসি,তার কথা,তার লাজুক মুখটা মনে পড়ছিলো বার বার।দিন দিন আমাকে দেখতে পাগলের মতো হয়ে গেল।নাওয়া-খাওয়া নেই,চোখের নিচে কালী জমে গেল,চুলগুলো উস্কো খুস্কো,দাড়িগোঁফ কামানো হয়নি।


এদিকে আব্বা আমার জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করল কারণ গ্রাম ছাড়া হলে বাঁচার উপায় থাকবে না।অন্যদিকে আমি তার কোনো খবর পাচ্ছিলাম না,বেশ কয়েকবার মুসলমানদের পাড়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু সুবিধে করতে পারিনি।


মাস খানিক পর,আব্বার জোড়াজুড়িতে দোকানে যাচ্ছিলাম তখন পাঞ্জাবী-টুপি পড়া এক বাচ্চা এসে সাইকেল দাঁড় করালো হাতে একটা চিরকুট দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো।


চিরকুট দেখে মনটা ধাক করে উঠল,হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো।কাঁপা কাঁপা হাতে চিরকুট খুলে দেখলাম তাতে লেখা আছে,


"প্রিয় রতন,


তুমি যে ভিন্নধর্মী তা না জেনেই আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি।তোমাকে আমার মনের কুঠুরিতে জায়গা দিয়েছি।তুমি হিন্দু জানার পরেও ভালবাসা কমেনি বিন্দু পরিমান।বাবা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে তার  মাদ্রাসার এক ছাত্রের সাথে।আমি বিয়ের দুদিন আগে পালিয়ে তোমার পাড়ায় গিয়েছিলাম কিন্তু তোমার ঠিকানা আমার অজানা তাই তোমার কাছে পৌঁছাতে পারিনি,তার আগেই বাবা আমাকে ধরে এনেছিলো।আমি বিয়ের দিন সকালেও তোমাকে খুঁজতে পালিয়ে গেছিলাম কিন্তু পাইনি।মৃত্যকে বরণ করতে চেয়েও পারিনি,তার আগেই বাবা আবার আমাকে নিয়ে এসেছে আর তার কসম দিয়েছে।আমি জানি তুমিও আমাকে ততোটাই ভালবাসো।যদি সেই ভালবাসা সত্য হয়ে থাকে তবে,তোমার আব্বার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে সুখে থেকো,কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিও না।


মনে রেখ,তুমি যাকে ভালবাসও সেও তোমাকে ভালবাসে।


তোমার


বর্ষা"


সেদিন দোকানে আর যাইনি,আসলে যেতে পারিনি।

নদীর তীরে বসে সেদিন খুব কেঁদেছি,আমার সাথে পাল্লা দিয়ে সেদিন আকাশটাও খুব কেঁদেছিলো।বৃষ্টির পানিতে সেদিন চোখের সব পানি ধুয়ে গেছিলো,তারপর আর কখনও কাঁদিনি।


আমিঃ দাদু বাসে ফিরতে হবে।


দাদুঃ চল।


 বাসে উঠে, 


আমিঃ আচ্ছা দাদু,আপনি কী বিয়ে করেছিলেন?


দাদুঃ হুম তবে সে মেয়ে দুই বছরের মাথায়,আমার ছোট্ট মেয়েকে রেখে অন্যের হাত ধরে পালিয়েছে।


আমিঃ শীট,তারপর?


দাদুঃ তারপর আর বিয়ে করিনি,আব্বা-আম্মাও জোর করতে পারেনি কারণ তাদের পছন্দের মেয়ে তো সংসার ছেড়ে অন্য ছেলের হাত ধরে পালিয়েছিল।


আমিঃ তারপর আপনি কী করলেন?


দাদুঃ তারপর শহরে পারি জমালাম,এখানে ব্যবসা শুরু করলাম,মেয়েকে নিজেই মানুষ করে বিয়ে দিয়েছি তার পছন্দের ছেলের সঙ্গে। 


আমিঃ এখন কোথায় যাচ্ছেন?


দাদুঃ আমাদের গ্রামে,সেখানে সব বদলে গেলেও আমাদের স্মৃতিগুলো এখনও তাজা আছে।


সেখানে গেলেই আমি বর্ষাকে খুঁজে পাই।সেখানকার বাতাসে আমাদের ভালবাসাকে খুঁজে পাই।


শুনশান নিরবতা,দাদুকে কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে করছে না।হয়তো সে হারিয়ে গেছে পুরনো দিনে,তার ভাবনায় ছেদ করা উচিত হবে না।

ইয়ারফোন কানে গুজে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছি আর ভাবছি,"কতটা ভালবাসলে এই বয়সে এসেও মানুষ তার প্রণয়ীর কথা মনে রাখে?"


কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা,কাঁদে মৃদু ধাক্কা লাগায় উঠে পড়লাম,দেখি সেই দাদু তার ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে নামার জন্য প্রস্তুত হয়ে আমাকে ডাকছে।


দাদুঃ আমি জানি অপরিচিত কেউ হঠাৎ গল্প শোনাতে চাইবে ব্যাপারটা অদ্ভুত।তুমি বিরক্তও হয়েছে প্রথমে তাও বুঝেছি,কিছু মনে করোনা,বুড়ো মানুষ ক্ষমা করে দিও।কিন্তু আমি যতবারই এ পথে আসি,কাউকে না কাউকে আমাদের গল্পটা শোনাই।এই আশায় যাকে শোনাব,সে তার বাড়ির মানুষগুলোকে এটা বলবেই যে বাসে এক পাগল বুড়ো তাকে জোর করে গল্প শুনিয়েছে,আর তার বাড়িতে যদি আমার প্রেয়সী থাকে,তাহলে সে জানবে তার রতন তাকে ভোলেনি,এখনও সেই প্রথম দিনের মতোই ভালবাসে।

আসি দাদুভাই।


আমঃ দাদু?


দাদুঃ হুম


আমিঃ আমি কী আপনার গল্পটা লিখতে পারি? সে তো বই পড়তে ভালবাসে,যদি পড়ে ফেলে আপনাদের নিয়ে লেখা বইটা?


দাদুঃ লিখতে পারো ভালো লাগলে,তবে গ্রামের নামটা বদলে দিও,যদি এতে তার বাসায় সমস্যা হয়?

আমিঃ আপনার ফোন নাম্বার?

দাদুঃ কার্ডটা রাখো।


দাদু চলে গেল,একবারও পিছনে ফিরে চাইল না।আমি তাকিয়ে তার চলে যাওয়া দেখছি,বাস এগিয়ে চলছে তার গন্তব্যস্থলে।


বাসায় ফিরে,

আমিঃ এখন আমি খেয়ে ঘুমাবো,বিকালে সবাইকে একটা গল্প শোনাব সবাই যেন থাকেই থাকে।বলেই ঘুমাতে গেলাম।


বিকেল বেলা,চায়ের কাপ হাতে

বাসের দাদুর গল্পটা শোনালাম সংক্ষেপে,নিরবতার ফাঁকে লুকিয়ে তোলার তার ছবিটা দেখালাম সবাইকে।

রাতের বেলা ছাঁদে এসে একটা অবয়ব দেখতে পেলাম,ধীর পায়ে কাছে গিয়ে বুঝলাম সে কাঁদছে কোনো কিছু বুকে জড়িয়ে ধরে।


তার কাঁদে হাত রাখব সেই মুহূর্তে পায়ের কাছে কাগজের টুকরো পেলাম হাতে নিয়ে দেখলাম সে যে বর্ষ পুরনো প্রেম পত্র।


কাঁদুক না একটু মন খুলে,নিঃশব্দে সিড়ির পানে এগিয়ে যাচ্ছি আর ভাবছি বড্ড দেরী হয়ে গেছে মনে পড়তে,মনেই পড়ল  না তখন বর্ষা যে আমার দাদির নাম।


ঘরে ফিরেই দাদুর দেয়া কার্ডটা নষ্ট করে ফেললাম,একটু স্বার্থপর হতেই হলো কারণ আমার দাদুভাই যে আমার দাদিকে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসে।

Comments

Post a Comment