Sultana | Bengali Love Story Pdf | Piprerdol
সুলতানা
" ইনশাআল্লাহ মহব্বত তুম গলে লাগালো... "
শাবানা বেগম নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠলেন...
প্রায় 60 এর কাছাকাছি বয়স বেগমজান এর এখনো তার রূপে ঝলসে মরে তার মজনুর দল ||
শহরের সবচাইতে আলিশান বাংলো " গালিচা ", বেগম তার একান্নবর্তী সংসার নিয়ে আল্লাহর মেহেরবাণী নিয়ে বুনে চলেছেন এক জীবন গাঁথা ||
প্রতিদিন মাহেফিল বসানোর আগে বেগমজান প্রায় আধ ঘন্টা আল্লাহর সঙ্গে নিজের সুখ-দুঃখের গল্প করেন ||
আজকেও ব্যাতিক্রম নয়,আজ আবার তার সবচেয়ে পছন্দের,সবচাইতে আদরের,হাজারো মে এক, জিগার কা টুকরা " সুলতানা "
এর জীবনের প্রথম মেহফিল,
বেগমজান নিজের হাতে আজ সুলতানাকে সাজাবেন,নিজের খানদানি হার-পায়েল-চুড়ি-টিকলি-মানতাসা-আংটি ইত্যাদি সাথে জমকালো সোনার সুতো দিয়ে কারুকার্য করা লেহেঙ্গা, সবশেষে চন্দন এর সুগন্ধি আতর আর একটা লালগোলাপ খোঁপায় ||
সুলতানা আজ ভীষণ খুশি আজ তার প্রথম মেহেফিল,সুলতানা জ্ঞান হয়ে ইস্তক এই " বাংলো " তার খুব আপন,আসলে লোকমুখে জেনেছে বেগমজান তাকে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পেয়ে বুকে করে নিজের মেয়ের মতো লালন করেছেন ||
সুলতানা এখন ষোলো,অভিধান মেনে সুন্দরী-হাঁটু ছাপিয়ে চুল,গান - নাচ আর সেতার এ অপরিসীম দক্ষতা ||
আজ প্রথম সে তথাকথিত বাইরের সমাজের সামনে নিজের রূপ আর গুনের ডালি উন্মোচন করবে,মনে মনে সে ছেলেমানুষি স্বভাবে বিচলিত ||
বেগমজান নিজের হাতে সাজিয়ে দিলেন,তারপর নিজেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন, " হায়,তেরি আদা,তেরি নূর,না জানে আজ কিতনে ঘ্যায়েল হোগা "
মেহেফিল শুরু হোলো...
চারিদিকে কেবল করতালি আর বাহ্বা...
গানের সুর আর সেতার ঝংকার তুললো,নাচের তাল ঝাড়বাতি কাঁপিয়ে দিলো আর তার সঙ্গে সঙ্গেই কাঁপলো অনেকগুলো হৃদয় ||
একেবারে শেষ সারিতে বসা এক মায়াবী দীঘি চোখের সাথে সুলতানা এর চোখের মিল হোলো,আর সবার মতো লোভাতুর নয় সে চোখের ভাষা এটুকু বুঝতে পারলো সুন্দরী...
সে চোখের প্রতিটি পল্লব আর শিরা-উপশিরা শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ,সুলতানা শিহরিত হোলো ||
সুভাষ চ্যাটার্জী গ্রামের ছেলে,একেবারে অজ গ্রাম যাকে বলে,বাবা গ্রামের একজন গণ্যমান্য ব্যাক্তি,তিন ভাইয়ের মধ্যে সুভাষ সবচাইতে ছোট,বাকি দুজন হাই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে পৈতৃক চাল আর পাটের ব্যাবসার কাজে হাত পাকিয়েছে,মেধাবী আর জেদি সুভাষ দুচোখে ডাক্তার হবার স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে কলকাতার এক মেসে ভাড়া থাকে,এক নামী প্রতিষ্ঠানে প্রথম বর্ষের ছাত্র,গান তার খুব প্রিয় ||
কলকাতা এসে প্রথমে সে খানিকটা অথৈ জলে পড়েছিল,ক্রমে ধীরে ধীরে মানিয়ে গুছিয়ে গেলো সব,মেসে অমল নামক এক অমূল্য বন্ধুও জুটে গেলো ||
আর নেহাত বয়সের মোহে,খানিকটা রোমান্টিক হবার ইচ্ছে নিয়ে,কিছুটা এই বিখ্যাত " গালিচা " এর হাতছানি,দুই যুবককে অতিথি বানালো,মেহেফিল এর ||
সুভাষ,হারিয়ে ফেললো নিজেকে...
সুলতানা-সুলতানা-সুলতানা
উফফফ কি জাদু
যেন রূপকথা ||
সুলতানা ক্রমশ নিজের রূপ আর গুণের ছটায় এগিয়ে যেতে থাকলো ||
অসংখ্য ভক্ত,কিছু তাবেদার কিছু লোভাতুর চোখ,কিছু মুগ্ধ দৃষ্টি মিলিয়েমিশিয়ে একাকার ||
কিন্তু সে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে চলে একজোড়া মায়াবী মুগ্ধ চোখ...
প্রায়দিন নিরাশ হয়,ছেলেমানুষ মন ||
সুভাষ প্রতিজ্ঞা করলো যেভাবেই হোক সে সুলতানার সঙ্গে আলাপ করবে,নইলে যে...
অনেক চেষ্টা করে,বেশ কিছু টাকার বিনিময়ে,অনেকটা অনুরোধ এর সীমানা পেরিয়ে,সুলতানার একান্ত আপন দাসী নাগমা রাজি হোলো সুলতানার কাছে বিশেষ চিরকুট পৌঁছে দিতে...
" প্রিয় সুলতানা
তুমি যখন এই চিঠি পড়বে আমি তখন তোমার কথা মনে করে হয়তো বিনিদ্র রজনী কাটাবো,আমার বোধহয় ডাক্তার হওয়া শিকেয় উঠলো...
নিজেই যে মস্ত এক রোগ বাধিয়ে বসে আছি,এ রোগ এর চিকিৎসা জানা নেই আমার,যদি জানা থাকে,সেবা পরম ধর্ম এই বাণী বিচার করে জানি ও ||
ইতি
শেষ সারির একজোড়া মুগ্ধ চোখ...
সুলতানা কেঁপে উঠে,একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো,চিরকুট হাতির দাঁতের বাস্কে সযত্নে বন্ধি হোলো ||
অপরজন সারারাত মেসবাড়ির জানলা ধরে আকাশের চাঁদ দেখতে দেখতে প্রথম প্রেম এর মায়াজাল বুনলো...
চারিদিক অশান্ত
ইংরেজ পরাধীনতার কবলে হাহাহাহা যেন আকাশ-বাতাস চিরে ফালাফালা করে দিচ্ছে,প্রতিটি যুবক হৃদয় তোলপাড়,পরাধীন ভারত মাতাকে বন্ধী দশা থেকে মুক্তি দেবার জন্য ||
প্রতিটি ভারতীয় এর রক্ত ফুটছে যেন গরম লাভা ||
কান ফাটানো চিৎকার
" বন্দেমাতরম "
সেই চিৎকার সুলতানা এর বুকে আছাড় খেলো...
" হে মাতৃভূমি তোমার পায়ের বেড়ি খুলে মুক্তি দেবে তোমার সন্তানরা,অপেক্ষা শুধু সময়ের "||
সুলতানা চিৎকার করলো
" বন্দেমাতরম "...
মেসবাড়িতে ও সমবেত কণ্ঠে স্বাধীনতার আহ্বান
" বন্দেমাতরম,জয় হিন্দ "||
সুভাষ গ্রামে চিঠি পাঠালো...
তার না যেতে পারার
কারণ হেতু ভারতমাতা এর জন্য মুক্তি যুদ্ধ, সে কথা জানিয়ে ||
উত্তরে পিতা-মাতা এবং অন্যান্য অভিভাবকগণ আশীর্বাদ এবং ছোটরা ভালোবাসা পাঠালো অফুরান
" গালিচা " তে এক বিশেষ বার্তা পৌঁছলো,স্বয়ং লর্ড সাহেব অথিতি হতে চান সুলতানা এর মেহফিল এর ||
চারিদিকে যার রূপ আর গুনের এতো বাহবা,লর্ড সাহেব নিজের চোখে পরখ করতে চান সেই রূপসুধা ||
সুভাষ এর বিনিদ্র রজনী ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে আরম্ভ করলো,একদিকে সুলতানা অপরদিকে ভারতমাতা আর ডাক্তার হবার স্বপ্ন ||
চরম বিপদ পেরিয়ে,গা ঢাকা দিয়ে আবার ও " গালিচা "||
সুলতানা ও দীর্ঘদিন অপেক্ষা এর পরে আবার তার প্রাণপুরুষ এর চোখের ভাষায় নিজেকে হারিয়ে ফেললো,মেহফিলে সৌরভ ছড়িয়ে পড়লো, দুটি নবীন প্রাণ এর ভালোবাসা এর সাক্ষী হোলো দামি ঝাড়বাতি ||
মেহফিল শেষ হোলো,সুলতানা প্রায় চোরের মতো খুব খুব সাবধানে ছাদে পৌঁছলো,বেগমজান জানতে পারলে,সাক্ষাৎ মৃত্যু এর পরোয়ানা,কিন্তু অপরজন যে অপেক্ষারত...
সুভাষ নিজের জামা ছিঁড়ে,হাত-পা জখম করে ভাঙা একখান পাইপ বেয়ে ছাদের এক্কেবারে ঈশান কোণে ||
আকাশের চাঁদ আর নির্মল বাতাস,জোনাকি আর শিউলি ফুলের গন্ধ,সুলতানার ওড়নার সালমা চুমকি আর সুভাষ এর কোমরে গোঁজা ভারতমাতার বীর সন্তানের উজ্জ্বল ছোড়া,সব সব মিলিয়ে মিশিয়ে এক অপূর্ব কবিতা যেন...
হটাৎ " বন্দেমাতরম " আর রাইফেল এর আর্তনাদ ||
ছন্দপতন হলো কবিতার...
সুভাষ প্রেয়সীকে বিদায় জানিয়ে কর্মযজ্ঞ হেতু এগিয়ে গেল আর সুলতানা চুপিসারে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পরে চিৎকার করে উঠলো " বন্দেমাতরম "||
লর্ড সাহেব এলেন নিদৃষ্ট দিনে
মেহফিল সেজে উঠলো,সুলতানা দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করলো,সুরের মূর্ছনায় জাদু ছড়ালো,লর্ড সাহেব সেই সুরের আবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন...
সুলতানা-সুলতানা-সুলতানা
লর্ড সাহেব ও নিজেকে হারিয়ে ফেললেন ||
আজ প্রায় চারমাস সুভাষ গা ঢাকা দিয়ে আছে এক গোপন ঘাঁটিতে...
প্রতিটি পদে পদে বিপদের আনাগোনা ||
ঘুমহীন চোখের পাতায় সুলতানা...
এ জীবনে কি আর দেখা হবে ?
সুলতানার চোখ কাতর,ক্লান্ত
মেহফিল এর তারিফ আর তার ভালো লাগে না ||
তার মনের গোপন কুটির হাহাকার করে
সুভাষ-সুভাষ-সুভাষ
ইনশাআল্লাহ,মোহাব্বত তু্ জালিম...
হটাৎ একদিন লর্ড সাহেব এর আগমন...
" গালিচা " তার চাই,এরকম আলিশান বাংলো তার খুব প্রিয় ||
বেগমজান চিৎকার করে উঠলেন " কাভি নেহি "
তিলতিল করে তিনি গড়েছেন এই ইমারতের প্রতিটা ইজ্জত প্রতিটা ইমান ||
লর্ড সাহেব দু দিন সময় দিলেন...
শর্ত দিলেন হয় " গালিচা " নয় " সুলতানা "||
বেগমজান মূর্ছা গেলেন ||
ডাক্তার এলো,ওষুধ এলো বেগমজান শয্যা নিলেন,সুলতানা পা জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদলো ||
লর্ড সাহেবকে আমন্ত্রণ জানালো সুলতানা ||
বেগমজান জানতে পেরে দুটো কথা বললেন...
" ইনশাআল্লাহ-ইনশাআল্লাহ "
গাড়ি এসে দাঁড়ালো নিদৃষ্ট দিনে,লর্ড সাহেব একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে এগিয়ে গেলেন নিদৃষ্ট ঘরের দিকে ||
সুলতানা আর ও একবার হাতির দাঁতের বাস্ক থেকে চিঠি নিয়ে পড়লো...
সুভাষ...
দরজায় টোকা...
সুলতানা দরজা খুলে অথিতিকে ভিতরে আসার ইশারা করলো ||
" সেলাম "
লর্ড সাহেব নিদৃষ্ট চেয়ারে বসলেন ||
সুলতানা হাতে সেতার তুলে গান শুরু করলো...
সেই গান গগন ভেদ করে ছড়িয়ে পড়লো বিশ্বলোকে,
লর্ড সাহেব চেয়ার থেকে নেমে সুলতানার ঠিক পাশে বসলেন,সুলতানা নিজের চোয়াল শক্ত করলো...
সাহেব একটা গোলাপ সুলতানা এর দিকে এগিয়ে দিলেন,সুলতানা তার কোমরবন্ধনি থেকে এক টুকরো বিদ্যুৎ এর চুম্বন একে দিল সাহেব এর বুকে,ফিনকি দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়লো,চিৎকার কাঁপিয়ে দিলো প্রতিটা ইট ||
যে যেদিকে ছিল ছুটে এলো...
" সুলতানা-সুলতানা "
দরজা ভাঙা হোলো...
সুলতানার দেহটার পাশে বিষের কৌটোটা যেন অট্টহাসি হাসছে ||
সুভাষ শেষ বারের মতো চিৎকার করলো
" বন্দেমাতরম " তারপর নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো,কিম সাহেব এর রাইফেল চিরঘুম এর দেশে পাঠালো আরও একটা তাজা প্রাণকে ||
লেখা : মধুমিতা গন
FB : @honey.mita
ছবি : মুন কুন্ডু
IG : @artisto_heartbeat
Comments
Post a Comment